আমাদের এই মহাবিশ্ব কল্পনার চেয়েও বড়। প্রতি মুহূর্তে এটি বেড়েই চলছে। সেই বিগ ব্যাং থেকে আজ অবধি। প্রায় ১৪ শত কোটি বছর ধরে সম্প্রসারিত হচ্ছে এই মহাবিশ্ব। সর্বোচ্চ দ্রুততায় (আলোর গতি-সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার) ভ্রমন করলেও ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোটি বছরেও আপনি এই মহাবিশ্বের শেষ খুঁজে পাবেন না। কারন যতক্ষণে আপনি এই পথ পাড়ি দেবেন মহাবিশ্ব আরো বড় হয়ে যাবে ততক্ষণে। কল্পনার চেয়েও বিশাল এই মহাজগত। কিন্তু মানুষ থেমে নেই। অজানাকে জানার তীব্র নেশা মানব মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে। সূর্যের মত একটি সাধারন নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সৌরজগতের সব কটি গ্রহ। বুধ,শুক্র,পৃথিবী,মঙ্গল,বৃহষ্পতি,শনি,নেপচুন,ইউরেনাস।
শুধু কি পৃথিবীতেই প্রান রয়েছে? অন্যান্য গ্রহ কিংবা অন্য কোন নক্ষত্রের সিস্টেমে কোন উপযোগী গ্রহে কেন প্রান নেই? এই মহাজগতে কি আমরা একা? একাকিত্ব বড় যন্ত্রনার।এই বিরহ জ্বালা থেকেই বোধহয় মানুষ পৃথিবীর বাইরে প্রানের খোঁজ করছে স্মরণাতীত কাল থেকে। রাতের আকাশে তাকিয়ে ভেবেছে আমাদের মত কিংবা আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান কোন সভ্যতা কি আছে কোটি কোটি মাইল দূরের কোন গ্রহে? কিন্তু এই সুবিশাল মহাজগতে প্রাণের খোঁজে মানুষের অনুসন্ধান চলছে নিরন্তর।আমরা কি শুধুই একা? এই কৌতুহল মিটাতে মানুষ গ্রহ গ্রহান্তরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে,পাঠিছে অসংখ্য মহাকাশ যান। মানুষ মূলত দুই ধরনের মহাকাশ যান পাঠায় পৃথিবীর বাইরে একটি হচ্ছে কৃত্রিম সেটেলাইট যেটি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে,অন্যটিকে বলে স্পেস প্রোব যেটি গ্রহ নক্ষত্রের গবেষনায় পাড়ি দেয় কোটি কোটি মাইল।
এ পর্যন্ত মানুষের তৈরী যে মহাকাশযানটি সবচেয়ে বেশী দূরত্ব অতিক্রম করেছে সেটি হল ভয়েজার ১। আশ্চর্যের বিষয় হল ভয়েজার ১ আমাদের সৌরজগরের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে বহুদূর এবং এখনো আমাদের সাথে ক্রমাগত যোগাযোগ করে চলেছে। যদিও বিরতিহীন ৪০ বছর ধরে ছুটে চলা এই স্পেসস্প্রোবটি ফ্রিকোয়েন্সির দূর্বলতার জন্য প্রথমের মত এখন আর কার্যকর নয়।কর্মক্ষমতা ধরে রাখার জন্য যানটির কিছু অংশ শাটল ডাউন করে দেয়া হয়েছে। সূর্যের আকর্ষনবলয় অর্থাৎ সৌরজগত পাড়ি দেবার পথে এই যানটি সৌরজগতের গ্রহ যেমন মঙ্গল,বৃহস্পতি,শনি ইত্যাদি গ্রহের হাই রেজুলেশন ছবি,তাদের গঠন,বৈশিষ্ট্য ইত্যাদির অনেক তথ্য পাঠিয়েছে যা মহাকাশ গবেষণায় উন্মোচিত করেছে বহুদিনের রহস্য। শনির বলয়ের পরিষ্কার ছবি,গ্যাসীয় গ্রহ বৃহষ্পতির রেডস্পট ইত্যাদি বহু বিষ্ময়কর তথ্য, ছবি পাঠিয়েছে আমাদের ভয়েজার ১।
আমরা এখন জানি সৌরজগত কত বড়। শুধুমাত্র সৌরজগতের গন্ডি পেরোতে আমাদের ভয়েজার ১ এর সময় লেগেছে প্রায় ৪০ বছর।অথচ ভয়েজার এর গতি সেকেন্ডে প্রায় ১৭ কিলোমিটার। শত শত কোটি কিলোমিটার আমাদের পরিচিত এই সৌরজগত। এখন ভয়েজার ১ ছুটে চলছে আন্তনাক্ষত্রিক স্থানে। আমরা জানি সূর্য একটি মাঝারি মানের নক্ষত্র,আমাদের গ্যালাক্টিক হোম মিল্কিওয়েতে রয়েছে ছোটবড় ৪০ হাজার কোটি তারা।একটি তারা সূর্যের চেয়েও কোটিগুন বড় হতে পারে। যেমন UY scuti।পৃথিবী থেকে ১৩ লক্ষগুন বড় আমাদের সূর্য,ভেবে দেখুন সূর্যের চেয়ে কোটিগুন বড় তারা আকারে কত বড় হতে পারে। আল্লাহু আকব।বিধাতা আসলেই মহান।
পাঠক মনে নিশ্চয় প্রশ্ন জেগেছে ভয়েজার ১ যদি আমাদের সৌরমণ্ডল ছেড়ে যায় তাহলে আরেকটি তারা সৌরসিষ্টেমে পৌছাতে কত সময় লাগবে তার? চলুন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি,আমাদের সূর্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী তারার নাম প্রক্সিমা সেন্টুরাই। আপনি যদি আলোরগতিতে ভ্রমন করেন তবে প্রক্সিমা সেন্টুরাইতে পৌছাতে আপনার সময় লাগবে ৪.৩ বছর। আর ভয়েজার ১? ভয়েজার ১ যে গতিতে চলছে (সেকেন্ডে ১৭ কিলোমিটা) তাতে তার প্রক্সিমা সেন্টুরাইতে পৌঁছতে সময় লাগবে ৪০ হাজার বছর!! এবার আসুন জানি কি উদ্দেশ্যে নাসার এই প্রজেক্ট?
মানব জাতির নানা ইতিহাস,গান,ভাষা,ভাষণ,বৈশিষ্ট্য এই ভয়েজার ১ এ গোল্ডেন ডিস্কে সিগন্যাল আকারে পাঠানো হয়েছে।অন্য কোন নক্ষত্রে যদি আমাদের মত কিংবা আমাদের চেয়ে উন্নত কোন সভ্যতা থেকে থাকে তবে যাতে তারা আমাদের অস্ত্বিত্ব খুঁজে পায় বা আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে এই উদ্দ্যেশ্যেই মূলত অনন্তের পথে যাত্রা করেছে ভয়েজার ১। ধারনা করা হচ্ছে ভয়েজার ১ এর গোল্ডেন ডিস্কটি ১০০ কোটি বছর অক্ষত থাকবে। কল্পনা করতে দোষ কোথায় হাজার কিংবা লক্ষ্য বছর পর ভয়েজার ১ এর সূত্র ধরে আমাদের পৃথিবীতে পাড়ি জমাবে দূরের কোন নক্ষত্রের কোন বুদ্ধিমান প্রানীর দল। সেইদিন হয়তো মানুষের আজন্ম লালিত কৌতুহলটির জবাব মিলবে
আমরা কি শুধুই একা?
মোজাদ্দেদ হাসান আদনান, এডভোকে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট